পরিশ্রম ও আগ্রহকে পুঁজি করে দিনের পর দিন এগিয়ে চলেছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার একমাত্র নারী মৌ চাষী করুণা রানী সরদার (৪৬)।
ছয় বছর ধরে সে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য মৌ বাক্স স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করে চলেছে। করুণার বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন ইউনিয়ন মুন্সীগঞ্জের চুনকুড়ি গ্রামে। সে ভূপেন্দ্র নাথ সরদারের স্ত্রী।
এলাকায় জনপ্রিয়তার কারণে বিগত ইউপি নির্বাচনে তিনি মহিলা ইউপি সদস্য নির্বাচিত হন। মৌ বাক্সের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লালন-পালন করে মৌমাছির স্বাভাবিক জীবনযাপনের সঙ্গে মিল রেখে মৌ চাষ করে করুণা রানী স্বাবলম্বী। মৌ চাষের আয়ের মাধ্যমে করুণা রানী এখন একটি স্বল্প আয়তনের চিংড়ি ঘের মালিক। দুটি কন্যা সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করার জন্য খুলনা বয়রা সরকারী মহিলা কলেজে ভর্তি করতে সক্ষম হয়েছেন। এ ছাড়া দৈনন্দিন পরিবারের ব্যয় নির্বাহ চালিয়ে যাচ্ছেন।
একদিকে অধিক মুনাফা অর্জন অন্যদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যের স্বাদ গ্রহণে করুণা রানী মৌ চাষে এগিয়ে আসেন বলে জানান। ২০০৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এ পেশার প্রতি অতি যত্নবান হয়ে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বামী ভূপেন্দ্র নাথ সব সময় তার পাশাপাশি থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে যাচ্ছেন। তার মৌ চাষের খামারের নাম 'দাদু ভাই' মৌমাছি খামার। করুণা জানান বিসিক ও প্রশিকার সহযোগিতায় চার প্রকারের মৌমাছি ডরসেটা, সেরেনা, ফোরিয়া ও মেলিফোরা জাত নিয়ে মৌ চাষ চালিয়ে আসছেন। বর্তমানে তার ৫৮ টি মৌ কলোনি বা মৌ বাক্স আছে।
মধু উৎপাদনের সময় ও ফুল সম্পর্কে বলেন মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে সে কারণে বিভিন্ন ফুলের সময় বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ হয় এ সময় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, মানিকগঞ্জ যেতে হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে রাইসরিষা, ধনিয়া, কালজিরা, তিল, ফুলের মধু সংগ্রহে শরিয়তপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল; মার্চ মাসে লিচু ফুলের মধু সংগ্রহে ঢাকা গাজীপুর, কাপাসিয়া, নাটোর, ঈশ্বরদী, পাবনাসহ অন্য স্থানে যেতে হয়। এবং এপ্রিল ও মে মাসে সুন্দরবনের খলিসা, গরান, কেওড়া, বাইনসহ অন্যান্য ফুলের মধু সংগ্রহ হয়।
জুন মাসে কালোতিল ফুলের মধু সংগ্রহে ডুমুরিয়া ও অন্যান্য স্থানে যেতে হয়। তিনি বলেন, এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একজন কর্মচারী রেখেছেন যার মাসিক বেতন সাড়ে ৩ হাজার টাকা। মৌ চাষের আয় ও ব্যয় সম্পর্কে আরো বলেন, যত বেশি মৌ বাক্স বা মৌ কলোনি হবে আয়ের পরিমাণ তত বেশি হবে। নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত মৌ বাক্স থেকে আয় করা সম্ভব হয়। জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তেমন কোনো ফুলের সমারোহ না থাকায় মৌমাছি খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এ সময় তাদের কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করতে হয়। তিনি বলেন, দশটি মৌ বাক্সের জন্য সপ্তাহে ৫ কেজি করে খাদ্য দিতে হয় যার মূল্য আসে তিনশত টাকা। এ ভাবে ৫ মাস খাদ্য দিতে হয়।
করুণা রানী বেসরকারি সংগঠন প্রশিকা, বারসিক ও সুশিলন থেকে এ কাজের জন্য কিছুটা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। ইতোমধ্যে বারসিকের সহযোগিতায় ভারতের তামিলনাড়ু গিয়ে মোম ও মধু দিয়ে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। যেমন মোম দিয়ে লিপজেল, সাবান ও বাম। বিভিন্ন আচার তৈরির প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছেন।
বর্তমানে তৈরি মালামাল বাজারজাতকরণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নিজে ও বারসিকের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে করুণা রানী তার মৌ চাষ প্রকল্পের কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেন। উৎপাদিত মধুর বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা না থাকায় ন্যায্যমূল্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে সরকারি সহযোগিতা না থাকায় নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। পুঁজির সঙ্কট থাকায় বেশি বেশি বাক্স স্থাপন করতে পারেন না।
বর্তমানে এলাকায় মধুর প্রতি কেজি দাম সাড়ে তিনশ' থেকে চারশ' টাকা। ফলে মধুর দাম বেশি না থাকায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান। মধুর কথা শুনলেই কার না জিহ্বায় জল আসে। মধুর উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যায় না। রূপচর্চা থেকে শুরু করে শরীরে শক্তি জোগাতে বিভিন্ন রোগ নিরাময়সহ অন্যান্য কাজে মধু ব্যবহার করা হয়। এলাকার অভিজ্ঞমহলসহ করুণা রানীর মতে মৌ চাষের প্রশিক্ষণ, প্রদর্শন, গবেষণা ও সংরক্ষণের জন্য মৌ চাষের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা প্রয়োজন। মৌ চাষ সমপ্রসারণের জন্য সহজে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। এলাকায় মৌ চাষের সমপ্রসারণ করা হলে সুন্দরবনের ওপর বহুলাংশে চাপ কমে যাবে। ফলে একদিকে রক্ষা পাবে সুন্দরবন অপরদিকে রক্ষা পাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হাত থেকে মৌয়ালরা।
তাকে দেখে এলাকার অনেকেই মৌ চাষে আগ্রহী হয়েছে কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও পুঁজির অভাবে অনেকেই শুরু করতে পারছে না আবার অনেকেই ঝরে পড়ছে শুরু থেকেই।তাদের দাবি সরকার বা কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যদি তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে দেশে মধুর চাহিদা পূরণ হবে সাথে সাথে কর্মসংস্থান ও পাবেন তারা।